ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান বলেন, ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান-এই ঐতিহাসিক অধ্যায়গুলো একে অপরের পরিপূরক। এগুলোকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর যেকোনো অপচেষ্টা আমরা প্রতিহত করবো। এসব আন্দোলনই আমাদের অহংকার, আমাদের আত্মপরিচয়ের অংশ।
তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, বড় রাজনৈতিক ভূমিকা পালনের পাশাপাশি শিক্ষার মানোন্নয়নেও আমরা দায়বদ্ধ। যারা গণঅভ্যুত্থানে রক্ত দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে তারা আমাদের কাঁধে কিছু দায় ও দায়িত্ব রেখে গেছে। সেই দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পরিবেশ নিশ্চিত করা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে বিশ্বাস ও সহযোগিতার বন্ধন অটুট রাখা।
আজ ১ জুলাই ২০২৫ মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষ্যে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তন (টিএসসি) আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। আলোচনা সভার শুরুতে দিবসটি উপলক্ষ্যে প্রকাশিত ‘স্মরণিকা’র মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
এসময় উপাচার্য আরও বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল মাত্র ৬০ জন শিক্ষক ও ৮৭৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে। আজ সেই প্রতিষ্ঠান পরিণত হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার এবং শিক্ষক আছেন প্রায় ২ হাজার। এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে ২০০টি প্রতিষ্ঠান। যেখানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। নিঃসন্দেহে, এটি আমাদের জন্য একটি গর্বের বিষয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলা কখনো শুধু একাডেমিক পরিসরে সীমাবদ্ধ ছিল না উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণগুলোতে সমাজের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। এই চলার পথ বহু শ্রম, ঘাম ও রক্তে রঞ্জিত এ কথা আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে। ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১ এবং ১৯৯০-এর প্রতিটি আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান ইতিহাসে গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান আমাদের সংগ্রামের নতুন অধ্যায়। দেশের মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ভরসা রেখেছে বলেই প্রতিটি ক্রান্তিকালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকে সাড়া দিয়েছে, রাস্তায় নেমেছে, আন্দোলন করেছে এবং অধিকার আদায় করে নিয়েছে। এটি সম্ভব হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি জনগণের অগাধ বিশ্বাসের কারণে।
তিনি বলেন, আমরা ২০২৪-এর অভ্যুত্থানকে একাডেমিকভাবে মূল্যায়নের উদ্যোগ নিয়েছি। এরই অংশ হিসেবে আমাদের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটি সঙ্গে যৌথভাবে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করেছে। ইতিহাসে কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রয়েছে বিশেষত ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে তাদের শিক্ষার্থীদের ভূমিকা আমাদের প্রেরণা জোগায়। আমাদের ২৪-এর অভ্যুত্থানের সঙ্গে এই ঘটনাগুলোর একটা ঐতিহাসিক সাদৃশ্য রয়েছে।
শিক্ষার্থীরা থাকবে পড়ার টেবিলে, আর শিক্ষকরা উদারতা ও সহনশীলতা নিয়ে শ্রেণিকক্ষে যাবেন উল্লেখ করে উপাচার্য বলেন, তবেই আমরা একটি গণতান্ত্রিক, মানবিক ও সচেতন জাতি গঠনের পথে এগিয়ে যেতে পারবো। সীমাবদ্ধতা আমাদের আছে। তবুও আমরা জাতীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিরূপ। কেবল সরকারের সহায়তায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যেতে পারে না। সমাজকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের পথ চলতে হবে। সে লক্ষ্যেই কমিউনিটি আউটরিচ আমাদের অঙ্গীকার।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ। তিনি বলেন, আজকের এই গৌরবময় দিনে- ১ জুলাই ২০২৫, আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক শতাব্দী ও চার বছরের এক দীপ্ত ইতিহাসের দ্বারপ্রান্তে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, এটি জাতির আত্মপরিচয়ের প্রতীক, সভ্যতা গঠনের শিকড় ও স্বাধীনতার জাগরণণগাথা। আজ যে দিনটি আমরা উদযাপন করছি, তার প্রতিপাদ্য-‘বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’। এটি কেবল একটি স্লোগান নয়, এটি আমাদের বোধ, আমাদের নৈতিক দায় এবং আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি।
অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মই হয়েছিলো বৈষম্য দূরীকরণের তাগিদে। তাই আজকের এই প্রতিপাদ্য ইতিহাসের ধারবাহিকতায় যেমন যুক্তিযুক্ত, তেমনি বর্তমান সময়ের বিবেচনায় তা অত্যন্ত উপযোগী।
তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে এর অন্তর্ভুক্তিমূলক বৈশিষ্ট্য। এখানে ধনী-গরিব, শহর-গ্রাম, নারী-পুরুষ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ-সংংখ্যালঘু সবাই পেয়েছেন সমান মর্যাদা। এখানে প্রতিটি কণ্ঠের রয়েছে মূল্য, প্রতিটি স্বপ্নের রয়েছে ছুঁয়ে দেখার অধিকার।
আলোচনা সভায় আরও অংশ নেন প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. এম. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক শামসুজ্জামান দুদু। সঞ্চালন করেন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মুনসী শামস উদ্দীন আহম্মদ।
এর আগে, সকাল সাড়ে ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল হল, হোস্টেল ও প্রশাসনিক ভবন থেকে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ শোভাযাত্রা সহকারে স্মৃতি চিরন্তন চত্বরে সমবেত হন। সেখান থেকে সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খানের নেতৃত্বে ক্যাম্পাসে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হয়। সকাল ১০টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সম্মুখস্থ পায়রা চত্বরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা, বিশ্ববিদ্যালয় ও হলসমূহের পতাকা উত্তোলন এবং কেক কাটা হয়। এসময় সংগীত বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে জাতীয় সংগীত ও উদ্দীপনামূলক দেশাত্মবোধক গান পরিবেশিত হয়। এছাড়া, বিদেশি শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে অন্য একটি সংগীত পরিবেশিত হয়।
দিবসটি উদযাপন উপলক্ষ্যে উপাচার্য ভবন, কার্জন হল, কলা ভবন ও ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও সড়কসমূহে আলোকসজ্জা করা হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষ্যে আর্থ এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের উদ্যোগে এক বিশেষ সেমিনার আয়োজন করা হয়।
০১/০৭/২০২৫
ফররুখ মাহমুদ
উপ পরিচালক
জনসংযোগ দফতর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়