ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান (ক্রিমিনোলজি) বিভাগের উদ্যোগে 'কারাগার, সংস্কার ও পুনর্বাসন; বাংলাদেশে সংশোধনাগার প্রতিষ্ঠানের চ্যালেঞ্জ' শীর্ষক একটি গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২৭ অক্টোবর সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে এই সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়, যা অপরাধ বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী, গবেষক, কারা কর্মকর্তা এবং গণমাধ্যমকর্মীদের একত্রিত করে বাংলাদেশের কারাগার ব্যবস্থার সংস্কার, পুনর্বাসন প্রক্রিয়া এবং বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে গভীর আলোচনা সৃষ্টি করেছে। এই সেমিনারটি দেশের সংশোধনাগার প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়ন এবং অপরাধীদের সমাজে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে।
সেমিনারের শুরুতে ক্রিমিনোলজি বিভাগের পক্ষ থেকে আগত অতিথিদের ফুলেল সংবর্ধনা প্রদান করা হয়।
প্রধান অতিথি কারা অধিদপ্তর, বাংলাদেশের অতিরিক্ত আইজি কারাগার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর কবিরকে একটি সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, কেরানীগঞ্জের সিনিয়র জেল সুপার সুরাইয়া আক্তার এবং কাশিমপুর কারাগার-২, গাজীপুরের সিনিয়র জেল সুপার আল মামুন। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন শাহারিয়া আফরিন, যাঁর নেতৃত্বে সেমিনারটি সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়।
সেমিনারের প্রথম অংশে কারা কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে একটি আকর্ষণীয় প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়, যাতে বাংলাদেশের কারাগার ব্যবস্থার বর্তমান কার্যক্রম, সংস্কারমূলক উদ্যোগ এবং পুনর্বাসন প্রক্রিয়া বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়। এই প্রামাণ্যচিত্রটি উপস্থাপন করেন সহকারী কারা পরিদর্শক (উন্নয়ন) মোঃ জান্নাত-উল-ফরহাদ, যাঁর উপস্থাপনা অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কারাগার ব্যবস্থার বাস্তব চিত্র সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। প্রামাণ্যচিত্রটি কারাগারের দৈনন্দিন চ্যালেঞ্জ, অস্তিত্বশীল সুবিধা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নিয়ে আলোকপাত করে, যা সেমিনারের মূল থিমের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।
এরপর, ক্রিমিনোলজি বিভাগের শিক্ষার্থীরা একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন, যাতে বাংলাদেশের সংশোধনাগার প্রতিষ্ঠানগুলোর চ্যালেঞ্জ এবং সমাধানের উপায় নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হয়। এই উপস্থাপনাটি শিক্ষার্থীদের গবেষণামূলক দক্ষতা প্রদর্শন করে এবং অতিথিদের মধ্যে আলোচনার সূত্রপাত ঘটায়। আগত অতিথিরা তাঁদের বক্তব্যে কারা কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা, যেমন অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, মানবসম্পদের অভাব এবং প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। একই সাথে, এসব চ্যালেঞ্জ অতিক্রমের লক্ষ্যে গৃহীত সম্ভাবনাময় উদ্যোগগুলো, যেমন নতুন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, পুনর্বাসন প্রোগ্রাম এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। প্রধান অতিথি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর কবির বলেন, “কারাগার শুধুমাত্র শাস্তির স্থান নয়, বরং সংস্কার এবং পুনর্বাসনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই সেমিনারটি আমাদের উদ্যোগগুলোকে আরও শক্তিশালী করবে।”
সেমিনারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল প্রশ্নোত্তর পর্ব, যেখানে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা কারাগার ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রশ্ন করেন। আগত অতিথিরা এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর প্রদান করেন, যা অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে জ্ঞান বিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি করে। এই পর্বটি সেমিনারকে আরও ইন্টারেক্টিভ এবং ফলপ্রসূ করে তোলে।
অনুষ্ঠানের শেষ অংশে ক্রিমিনোলজি কালচারাল ক্লাবের সৌজন্যে একটি মূকাভিনয় প্রদর্শিত হয়, যা কারাগারের অভ্যন্তরীণ জীবন, সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা এবং পুনর্বাসনের গুরুত্বকে চিত্রিত করে। এই মূকাভিনয়টি অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে গভীর ছাপ ফেলে এবং সেমিনারের থিমকে সৃজনশীলভাবে উপস্থাপন করে।
সমাপনী বক্তব্যে আহ্বায়ক এবং বিভাগের চেয়ারপারসন শাহারিয়া আফরিন সেমিনারে আগত সকল অতিথি, শিক্ষার্থী, গবেষক এবং গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন, “এই সেমিনারটি শুধুমাত্র আলোচনার মাধ্যম নয়, বরং বাংলাদেশের কারাগার ব্যবস্থার সংস্কারে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। আমরা ভবিষ্যতে কারা কর্তৃপক্ষ এবং ক্রিমিনোলজি বিভাগের মধ্যে বিভিন্ন গবেষণামূলক কার্যক্রমে একত্রে কাজ করার আশা করি, যাতে অপরাধীদের পুনর্বাসন আরও কার্যকরী হয় এবং সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।”
এই সেমিনারটি অপরাধ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে জ্ঞানের প্রসার এবং নীতিগত উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি প্রমাণ করে যে, একাডেমিক এবং প্রশাসনিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের কারাগার ব্যবস্থাকে আরও মানবিক এবং কার্যকরী করে তোলা সম্ভব।